"নিগ্রোম্যান্সি" (Necromancy), যা সাধারণভাবে "মৃত আত্মাদের সাথে যোগাযোগ" বা "শয়তানীয় জাদুবিদ্যা" নামে পরিচিত, একটি প্রাচীন এবং বিতর্কিত জাদুবিদ্যার শাখা। এটি মূলত মৃত ব্যক্তিদের আত্মা ডেকে আনা এবং তাদের কাছ থেকে ভবিষ্যদ্বাণী বা গোপন জ্ঞান লাভের জন্য ব্যবহৃত হয়। নিগ্রোম্যান্সি শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ "νεκρός" (nekros) যার অর্থ "মৃত" এবং "μαντεία" (manteia) যার অর্থ "ভবিষ্যদ্বাণী" থেকে।
নিগ্রোম্যান্সির সংজ্ঞা
নিগ্রোম্যান্সি হল এমন একধরনের জাদুবিদ্যা যেখানে মৃত ব্যক্তিদের আত্মাকে ডেকে আনা হয়:
- উদ্দেশ্য: অতীতের গোপন তথ্য জানা, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা, বা জীবিত ব্যক্তিদের উপর প্রভাব বিস্তার করা।
- পদ্ধতি: এই আচার-অনুষ্ঠান প্রায়শই প্রার্থনা, মন্ত্র, এবং সিলমোহর ব্যবহার করে সম্পন্ন করা হয়।
নিগ্রোম্যান্সির মূল উৎস
প্রাচীন সভ্যতা:
- নিগ্রোম্যান্সি প্রথম দেখা যায় প্রাচীন গ্রিস, মিশর, এবং রোমে।
- গ্রিক পুরাণে ওডিসিয়াস (Odysseus) মৃত আত্মাদের ডেকে আনার জন্য আচার-অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেছিলেন।
- মিশরে পিরামিডের গোপন কক্ষে এবং মমি ব্যবস্থাপনায় মৃতদের আত্মার উপর কাজ করার প্রমাণ পাওয়া যায়।
মধ্যযুগ:
- মধ্যযুগে নিগ্রোম্যান্সি খ্রিস্টান ধর্মের দ্বারা নিষিদ্ধ ছিল, কারণ এটি শয়তানের সাথে চুক্তি করার সমতুল্য বলে ধরা হত।
- এই যুগে নিগ্রোম্যান্সিকে কালো জাদু বা "ডার্ক ম্যাজিক" হিসেবে বিবেচনা করা হত।
পদ্ধতি এবং আচার-অনুষ্ঠান
নিগ্রোম্যান্সির জন্য কিছু নির্দিষ্ট পদ্ধতি এবং আচার-অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে হয়:
- স্থান:
- সাধারণত কবরস্থান, নির্জন স্থান, বা ভূতুড়ে জায়গা নির্বাচন করা হয়।
- সরঞ্জাম:
- মন্ত্রপাঠের জন্য পবিত্র বই, মোমবাতি, ধূপ, এবং বিশেষ ধাতব পাত্র।
- মৃত ব্যক্তির ব্যক্তিগত সামগ্রী বা হাড় ব্যবহৃত হয়।
- মন্ত্র এবং ডাক:
- নিগ্রোম্যান্সি করার জন্য শক্তিশালী মন্ত্র ব্যবহার করা হয়, যা মৃতদের আত্মাকে ডেকে আনতে সাহায্য করে।
- দেবতা বা আত্মার সঙ্গে চুক্তি:
- কখনো কখনো আত্মা বা শয়তানের সঙ্গে চুক্তি করার মাধ্যমে শক্তি আহরণ করা হয়।
নিগ্রোম্যান্সির উদ্দেশ্য
- ভবিষ্যৎ জানা: মৃত আত্মার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানার চেষ্টা করা।
- গোপন তথ্য: অতীতের রহস্য বা হারিয়ে যাওয়া জিনিসের তথ্য জানা।
- প্রতিশোধ: কারও বিরুদ্ধে অভিশাপ দেওয়া বা প্রতিশোধ নেওয়া।
- শক্তি আহরণ: মৃত আত্মার সাহায্যে জীবিত ব্যক্তির ওপর প্রভাব ফেলা বা তাদের নিয়ন্ত্রণ করা।
ধর্মীয় এবং নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি
- ইসলামী দৃষ্টিকোণ:
- ইসলাম নিগ্রোম্যান্সি বা শয়তানীয় কার্যকলাপকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে। এটি শিরক (অন্যের উপাসনা) এবং হারাম হিসেবে বিবেচিত।
- কোরআনে জাদুবিদ্যা এবং আত্মা ডাকার বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে (সূরা বাকারা: ১০২)।
- খ্রিস্টান দৃষ্টিকোণ:
- বাইবেল নিগ্রোম্যান্সিকে ঈশ্বরের প্রতি অবাধ্যতা এবং শয়তানের উপাসনা হিসেবে দেখেছে।
- রাজা শৌল যখন মৃত ভবিষ্যদ্বক্তা সামুয়েলের আত্মাকে ডেকেছিলেন, তখন তাকে শাস্তি পেতে হয়েছিল (১ শ্যামুয়েল ২৮)।
- হিন্দু ধর্ম:
- হিন্দু ধর্মে আত্মাদের সঙ্গে যোগাযোগ সাধারণত পূজা-পার্বণ এবং শ্রাদ্ধে সীমাবদ্ধ। তবে এটি কোনও অপশক্তির সাথে সম্পর্কিত নয়।
নিগ্রোম্যান্সি এবং কালো জাদু
নিগ্রোম্যান্সিকে কালো জাদুর একটি শাখা হিসেবে ধরা হয়:
- এটি সাধারণত শত্রুদের ক্ষতি করতে বা অভিশাপ দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়।
- শয়তান, আত্মা, বা অশুভ শক্তির সাহায্য নেওয়া হয়।
নিগ্রোম্যান্সির ঝুঁকি
- আত্মার প্রতিশোধ: ডাকা আত্মা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে এটি ডাকার ব্যক্তিকে ক্ষতি করতে পারে।
- মানসিক প্রভাব: জাদুবিদ্যার চর্চার সময় মানসিক এবং শারীরিক ক্ষতির ঝুঁকি থাকে।
- শয়তানের প্রভাব: আত্মাদের সঙ্গে চুক্তি করলে তা জীবনের ওপর দীর্ঘমেয়াদী শয়তানীয় প্রভাব ফেলতে পারে।
আধুনিক নিগ্রোম্যান্সি
আজকের দিনে নিগ্রোম্যান্সি সাধারণত কল্পকাহিনী, সিনেমা, এবং ফ্যান্টাসি সাহিত্যে বেশি ব্যবহৃত হয়:
- সাহিত্য: নিগ্রোম্যান্সির ধারণা হ্যারি পটার এবং লর্ড অফ দ্য রিংসের মতো বইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- সিনেমা এবং ভিডিও গেম: ফ্যান্টাসি গেম এবং হরর মুভিতে নিগ্রোম্যান্সি অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি উপাদান।
উপসংহার
নিগ্রোম্যান্সি একটি প্রাচীন এবং রহস্যময় জাদুবিদ্যার শাখা, যা মৃত আত্মাদের সঙ্গে যোগাযোগের উপর নির্ভরশীল। যদিও এটি প্রাচীন সভ্যতায় গুরুত্বপূর্ণ ছিল, বর্তমান যুগে এটি ধর্মীয়ভাবে নিষিদ্ধ এবং নৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য। নিগ্রোম্যান্সি চর্চা বিপজ্জনক এবং অশুভ প্রভাব ফেলতে পারে। তাই এটি একটি বিতর্কিত এবং রহস্যময় জাদুবিদ্যা হিসেবে ইতিহাসে রয়ে গেছে।